Until the Lions have their own historians, the history of the Hunt will always glorify the hunter.

কথাটি বলেছিলেন চিনুয়া আচেবে নামের এক নাইজেরিয়ান নভেলিস্ট। ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছে আমাদের মানে ভারতীয়দের ইতিহাস নিয়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজেরা নিজেদের ইতিহাসের কথা বলবো না ততদিন পর্যন্ত অন্যেরা আমাদের ইতিহাস বিকৃত করে বা মুছে দিয়ে আমাদেরকে নিকৃষ্ট নগণ্য হিসাবেই দেখাতে থাকবে। তাই আমাদের নিজেদের ইতিহাস আমাদের নিজেদেরকেই বলতে হবে এবং আগামী প্রজন্মকে এই গৌরবময় ইতিহাস জানাতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতার 70 বছর পরেও আমরা আমাদের নিজেদের ইতিহাস নিয়ে এতটুকুও মাথা ঘামাচ্ছি না। ছোটবেলা থেকে যে ইতিহাস বই আমাদেরকে পড়ানো হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই ইতিহাস কম গল্পের বই বেশি। ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসকে মুছে দেওয়া হয়েছে । এরকম কিছু মুছে দেওয়া ইতিহাস নিয়ে কয়েকটি পোস্ট দেবো বিস্মৃত ইতিহাস সিরিজে | এইটা তার প্রথম খন্ড |

রাজা সুহেলদেব

বাহরাইচের যুদ্ধ

১৩-১৪ জুন ১০৩৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা সুহেলদেব এবং গাজী সৈয়দ সালার মাসুদের বাহিনীর মধ্যে অধুনা উত্তরপ্রদেশের বাহরাইচ শহরের চিত্তৌরা হ্রদের কাছে এক যুদ্ধ হয়েছিল। এক লাখের বেশি আক্রমণকারী গজনভিদ সেনাবাহিনী পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং ভারতীয় উপমহাদেশে আক্রমণকারী মুসলিমদের বিজয়রথ থামিয়ে দেওয়া এই যুদ্ধকে আমাদের ইতিহাস ভুলে গেছে | মনে করে দেখুন, ছোটবেলা থেকেই আমাদের পড়ানো হয়েছে প্রথমে আক্রমণ করে সবাইকে পরাজিত করে সব লুট করে নিয়ে গেল মহম্মদ গজনী ওরফে মাহমুদ গজনবী আর তারপর আসে মহম্মদ ঘোরী | কিন্তু মহম্মদ গজনী আর মহম্মদ ঘোরীর মধ্যে ১৪৫ বছরের তফাত আছে | এই ১৪৫ বছরের ইতিহাস আমাদের কে জানতেই দেওয়া হয় নি | কারণ এই ইতিহাস জানলে ভারতীয়রা অবচেতন মনে নিজেদের যে পরাজিত লুণ্ঠিত জাতি হিসাবে মেনে নিয়েছে সেটা বিঘ্নিত হবে |

পটভূমি

১০২৬ খ্রিস্টাব্দে সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করার সময় গজনির মাহমুদ তাঁর ১১ বছর বয়সী ভাগ্নে সৈয়দ সালার মাসুদকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। সৈয়দ সালার মাসুদ মুহাম্মদ ইবনে আল-হানাফিয়াহর বংশধর গাজী সালার সাহু এবং মাহমুদ গজনবীর বোন সিতর-ই-মুয়াল্লার ছেলে ছিল। মাহমুদ গজনবীর মৃত্যুর পরে, গাজী সৈয়দ সালার মাসুদ গজনবী সেনাপ্রধান হয় | ১০৩৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে এক লক্ষ শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে মাসুদ ভারত আক্রমণ করেছিল। তার প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল দিল্লির রাজা মাহীপাল তোমর-এর সাথে | এই যুদ্ধেই মাসুদের হাল বেহাল হয়ে গেছিল | গজনবী সম্রাজ্য থেকে সময়মত অতিরিক্ত সেনাবাহিনী না এসে পড়লে হয়তো মাহীপাল তোমরের হাতেই মারা পড়তো মাসুদ | এই অতিরিক্ত সৈন্যবলের কারণে মাহীপাল তোমর পরাজিত হন | এখান থেকে মাসুদ মীরাটের অভিমুখে যাত্রা করে, যার শাসক রাজা হরি দত্ত আত্মসমর্পণ করে ইসলাম গ্রহণ করে নেয়। এখান থেকে মাসুদ বুলন্দশহর ও বাদাউন হয়ে কন্নৌজে যাত্রা করে। কন্নৌজ বিশাল পরিমাণ সম্পদ মাসুদের হাতে তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে । এই সময়কালে শ্রাবস্তী রাজ্য রাজা সুহেলদেব দ্বারা শাসিত ছিল | যিনি সাকারদেব, সুহিরধ্বজ, সুখদেব প্রভৃতি বিভিন্ন নামেও পরিচিত| তিনি মঙ্গলধ্বজের পুত্র ছিলেন এবং বালক ঋষির শিষ্য ছিলেন যাঁর আশ্রম বহরাইচে অবস্থিত। তাঁর বংশের বিষয়ে নানা মত আছে | জনপ্রিয় সংস্কৃতি এবং স্মৃতিতে তিনি পাসি রাজাদের মধ্যে একজন হিসাবে পরিচিত | তবে কেউ কেউ তাঁকে নাগবংশী ক্ষত্রিয় বা কেউ কেউ ব্যাস রাজপুত বলেও দাবি করেছেন। মাসুদ সালার মাসুদের আগ্রাসনের সময় লখিমপুর, সীতাপুর, লখনৌ, বড়বঙ্কি, উন্নাও, ফৈজাবাদ, বহরাইচ, শ্রাবস্তি, গন্ডা প্রভৃতি অঞ্চলগুলিতে রাজা সুহেলদেবের অধীনে ২১ টি পাসি সম্প্রদায় ছিল। সেগুলি হল ১) রাই সাহেব ২) অর্জুন ৩) ভাগগান ৪) রাই রাইব ৫) গঙ্গ ৬) মাকরান ৭) শঙ্কর ৮) করণ ৯) বীরবল ১০) জয়পাল ১১) শ্রীপাল ১২) হরপাল ১৩) হরকরন ১৪) হরখু ১৫) নরহর ১৬) ভালার ১৭) জুধারী ১৮) নারায়ণ ১৯) ডাল ২০) নরসিংহ ২১) কল্যাণ।

যুদ্ধ

মীরাট, কন্নৌজ ও মালিহবাদে অভিযানে বিজয়ী হওয়ার পরে মাসুদ বড়বঙ্কি জেলার সাতরিখে এসে পৌঁছায়। সাতরিখ হিন্দুদের জন্য একটা তীর্থস্থান ছিল | সাতরিখে গুরু বশিষ্ঠ শ্রীরামচন্দ্র এবং লক্ষ্মণকে শিক্ষা দিয়েছিলেন | সাতরিখকে তার ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে, মাসুদ তার সেনাবাহিনীকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি জয় করতে পাঠায়। মিয়া রজব আর সালার সাইফুদ্দিন বহরাইচ আক্রমণ করে।আমির হাসান আরব মাহোনা আক্রমণ করে, মালিক ফজল বারাণসী আক্রমণ করে। সায়াদ সাহু মানিকপুর ও কররা আক্রমণ করে। সায়াদ আজিজ-উদ্দিনকে হারদোর আক্রমণ করতে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু গোপামাউ তেই যুদ্ধের মুখে পড়তে হয়েছিল আজিজ-উদ্দিনকে | ধুন্দগড় দুর্গে তেজপাল অহীর এই গজনবী আক্রমণ আটকে দেন | ধুন্দগড় দুর্গে সামরিক সাহায্য পাঠাতে আর্জি আসে মাসুদ সালারের কাছে | এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মাসুদ তার ধর্মীয় শিক্ষক “সৈয়দ ইব্রাহিম মাশহাদি বারাহ হাজারী’ কে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল। ‘আইন-ই-মাসুদি’ অনুসারে সৈয়দ ইব্রাহিম মাশহাদী বারাহ হাজারী যেখানেই যেতো সেখানে কোনও অমুসলিম তার তরোয়াল থেকে বাঁচতে পারতো না যতক্ষণ না সে ইসলাম গ্রহণ করে। তবে ধুন্দগড়ের যুদ্ধে তেজপাল অহীর-এর হাতে এই হাজারী সমেত আরও বেশ কয়েকজন গজনবী সেনাপতি মারা পড়ে। এই হাজারীর সমাধি রেওয়ওয়ারীর নিকটবর্তী আলওয়ার জেলার শহর টিজারা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে কোট কাসিমে অবস্থিত।এদিকে বহরাইচে , সালার সাইফুদ্দিনকে ঘেরাও করা হয়েছিল | সাইফুদ্দিনকে বাঁচাতে সালার মাসুদকে বর্তমানে সালরপুর নামে পরিচিত একটি শহরের নিকটে সাকেতের উপকণ্ঠে অযোধ্যা অভিমুখে যাত্রা থামাতে হয়েছিল এবং উত্তর দিকে ফিরে গিয়ে বাহরাইচে সালার সাইফুদ্দিনকে সাহায্য করতে যেতে হয়েছিল | বাহরাইচের সর্দাররা রাপ্তি নদীর শাখা, ভকলা নদীর কাছে জড়ো হয়েছিল । ইসলামিক সেনাবাহিনী তার সেনাপতি মীর নসরুল্লাহর মৃত্যুর সাথে সাথে ভেঙে পড়ে। মীর নসরুল্লাহর সমাধি বহরাইচ থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে ডিকোলি খুরদ গ্রামে অবস্থিত। শীঘ্রই সালার মিয়া রজবকেও হত্যা করা হয়েছিল। মিয়া রজব সালার মাসুদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিল | তার সমাধিটি বহরাইচের তিন কিলোমিটার পূর্বে শাহপুর জোত ইউসুফ গ্রামে অবস্থিত এবং “হাতিলা পীর” নামে পরিচিত। রাজা সুহেলদেব পাসি সালার মাসুদের শিরশ্ছেদ করেছিলেন | রাজা সুহেলদেবের গুরু বালক ঋষির আশ্রমের পবিত্র সূর্যকুন্ডের কাছে একটি মহুয়া গাছের নীচে সালার মাসুদের মাথা কেটে দেন সুহেলদেব। তাঁর এই জয়ের স্মরণার্থে শ্রাবস্তীর আশেপাশে বিভিন্ন জলের ট্যাংক নির্মাণ করেছিলেন ।

পরিণাম

এই বহারাইচের যুদ্ধের ফলে গজনবী সেনা পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়ে গেছিল | ইসলামিক আগ্রাসনের বিজয়রথ আগামী ১৪৫ বছরের জন্য থমকে গেছিল | এই সময়ে আরও অনেক হিন্দু রাজা ও রাজবংশ ক্ষমতায় আসে | রাজপুত রাজা চন্দ্রদেও তাঁদের মধ্যে একজন | ইসলামিক আক্রমণকারীরা, যারা এখানে রয়ে গেছিল, তারা এই যুদ্ধে মারা যাওয়া সেনাদের “গাজী”, “বাবা”, “পীর” ইত্যাদি উপাধি দিয়ে সমাধি বানিয়ে আধাত্মিক ছলনা করে পরবর্তী আক্রমনের জন্য তৈরি হতে শুরু করে | পরবর্তীকালে, প্রায় ৩১৮ বছর পর ১৩৫১ সালে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক রাজা সুহেলদেবের গুরু বালক ঋষির আশ্রমের পবিত্র সূর্যকুন্ডের কাছে, যেখানে সালার মাসুদের মাথা কাটা পড়েছিল সেখানে মাসুদ সালারের নামে মাজার বানায় | আজও হিন্দুদের সেই পুণ্যস্থানে ইসলামিক আক্রমণকারী মাহমুদ গজনীর উত্তরাধিকারী মাসুদ সালারের কবরস্থান আছে | যেখানে প্রতি জৈষ্ঠ মাসে মুসলিমরা তীর্থ করতে যায় | আর আমরা রাজা সুহেলদেবের নামও জানি না | আমরা তেজপাল অহীরের নাম আগে কোনদিন শুনিনি | ওরা এই সূর্যকুণ্ডের নাম বদল করে নাম রেখেছে “হজ সামশি” | পারসিয়ান ভাষায় সূর্যকুণ্ড | ভারতের বোধহয় এই একটা মাত্র জায়গা আছে যেখানে মুসলমানরা সূর্যের আরাধনা করে | এই যুদ্ধের স্মরণে “সুহেলদেব স্মারক সমিতি” দ্বারা চিত্তোরা হ্রদের নিকটে একটি মন্দির নির্মিত হয়েছে যেখানে রাজা সুহেলদেবের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। বিজয় উত্সব মেলা, যজ্ঞ এবং মিছিল করে পালিত হয়। দশেরার সময় অস্ত্র পূজার আয়োজন করা হয়। বসন্ত পঞ্চমীর দিন রাজা সুহেলদেবের রাজ্যভিষেক অত্যন্ত ধুমধামের সাথে উদযাপিত হয়। ২০০১ সালে “মহারাজা সুহেলদেব সেবা সমিতি” গঠিত হয়েছিল। আজ এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি নাটক সংস্থা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুহেলদেব এবং তাঁর বিখ্যাত বিজয়ের গল্প মঞ্চায়িত করে। ৬০ এর দশকের পরে, রাজা সুহেলদেব নামটি প্রকাশ্যে বিভিন্ন প্রার্থীদের দ্বারা হিন্দুদের বিশেষত পাসি ও ভর সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ভোট পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রচারে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। ভারত ক্রান্তি রক্ষা পার্টি (বিকেআরপি) এর মতো ছোট স্থানীয় দলগুলি ছাড়াও বিএসপি থেকে এসপি পর্যন্ত সমস্ত বড় রাজনৈতিক দল ভোট সংগ্রহের জন্য রাজা সুহেলদেবের নাম ভাঙায়। “সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টির” মতো ছোট বর্ণভিত্তিক দলও তাঁর নামে ভোট পায়।

References:

  • Mirat-e-Masudi
  • Bahraich: A Gazetteer being Vol. XLV of the District Gazetteers of the United Provinces of Agra and Oudh
  • Fisher & Hewett, 1884: Statistical, descriptive and historical account of the North-Western Provinces of India
  • Visuvalingam Sunthar, 1992:Between Mecca and Banaras: An Acculturation Model of Hindu-Muslim Relations
  • Narayan, Badri (2009). Making of a Warring Hero: Hindutva Politics of Memory and Forgetting. SAGE Publications. ISBN 978-8-17829-906-8.
  • Legend of Suheldev – The King Who Saved India

By Anindya Nandi

Anindya Nandi is a Veteran of the Indian Navy. An IT graduate from Mumbai University, Served the Navy for 15 years from 1996 to 2011. Took part in Operation Talwar (Kargil War) and was in a support team during Operation Parakram. Visited 12 foreign nations while serving as a part of Indian goodwill visit to Foreign Countries. Trained in Nuclear Biological and Chemical Defence and Damage Control activities Including Fire Safety. Keen to observe geopolitical developments and analyze them with his own opinion.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights