গতকাল একটা খবরের দিকে নজর গেল | বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওত একজন আমেরিকানের নামে হিমাচলের কোনো একটা স্মৃতিসৌধ বা কোনো রাস্তার নামকরন করার জন্য হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুরকে অনুরোধ করেছেন | খবরটা পড়ে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে কে এই আমেরিকান ব্যক্তি ? যাঁর নাম ছিল স্যামুয়েল স্টোক্স | খবরের কাগজের হিসাবে হিমাচলে প্রথমবার আপেল নিয়ে আসা ও আপেলের চাষ হিমাচলে সর্বপ্রথম ইনিই শুরু করেছিলেন | ওনার চিন্তা আর দুরদর্শিতার জন্যেই আজ হিমাচলকে Apple Bowl বলা হয় | কিন্তু কঙ্গনা রানাওতের এই অনুরোধের পিছনে কি শুধু কি সেটাই কারণ ? এই আপেলের গল্পটা আসলে ওনার সম্পূর্ণ কাহিনী নয় | পুরো ঘটনা শুনলে/পড়লে আপনারও মনে হবেই যে কঙ্গনা ঠিক দাবী করেছেন | এই কাহিনী হলো পুরো হিমাচলকে খ্রিস্টান মিশনারীদের হাত থেকে বাঁচানোর কাহিনী | এই কাহিনী হলো আর্য সমাজের সেবা ধর্মের কাহিনী যার জন্যে ব্রিটিশ ভারতের হিমাচল শুধু খ্রিস্টান মিশনারীদের কবল থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছিল তাই নয়, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও এক অদ্ভুত অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল | এই কাহিনী আমেরিকার এক শহর ফিলাডেলফিয়া থেকে শুরু হয়ে সিমলার এক মন্দিরে শেষ হয় |
এই কাহিনী এক খ্রিস্টান পাদ্রী থেকে শুরু হয়ে একজন হিন্দু সনাতন সন্যাসীর ধর্ম জাগরণে শেষ হয় |আজ থেকে প্রায় ১৩৯ বছর আগের কথা | ১৬ই আগস্ট ১৮৮২ সালে আমেরিকার শহর ফিলাডেলফিয়ার একটা সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারে এক শিশুপুত্র জন্মগ্রহণ করে | বাবা মা তার নাম রাখেন স্যামুয়েল ইভান স্টোক্স | উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে স্যামুয়েলের পড়াশোনা শুরু হয় নামী দামী স্কুলে | কিন্তু ছোট বেলা থেকেই স্যামুয়েল একটু আধ্যাত্মিক প্রকৃতির ছিলেন | তাই তাঁর বাবা মা তাঁকে কনভেন্ট স্কুলে এক পাদ্রীর কাছে পড়তে পাঠান | আধ্যাত্মিক স্যামুয়েল চার্চের পাদ্রীর কাছে বাইবেল আর খ্রিস্টান মিশনারীদের ক্রিয়াকলাপের বিষয়ে পড়তে শুরু করেন | স্যামুয়েলের বয়স যখন ২০/২১ তখন কনভেন্টের পাদ্রীদের আদেশে স্যামুয়েল ভারতে আসেন | তাঁকে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভারতের খ্রিস্টান মিশনারীর প্রচার প্রসার করার | ২১ বছরের স্যামুয়েল ১৯০৩ সালে চার্চের আদেশে ভারতে খ্রিস্টান মিশনারীর প্রচার প্রসার করতে ভারতের বম্বে শহরে এসে পৌঁছান | সেই সময় ভারতে মিস্টার এন্ড মিসেস কার্লটন কুষ্ঠ রোগ নিয়ে গবেষণা ও কুষ্ঠ রোগীদের সেবা করার কাজ করছিলেন | যুবক স্যামুয়েলও ওনাদের সাথে মিলে কুষ্ঠ রোগীদের সেবা কাজে লেগে পড়লেন | সেবার আড়ালে ধর্মান্তকরণের খেলা এখন যেমন চলে তখনও চলত | ইশামশির নাম করলেই আর চৌবাচ্ছার জলে ডুব দিলেই রোগ সেড়ে যাবে – এই ভাঁওতা দিয়ে ধর্মান্তকরণের কাজ শুরু করে দেন স্যামুয়েল | বম্বে বা সমতলের বেশ কিছু জায়গাতে এই ধান্দা চালনোর পর সমতলের গরম আবহাওয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে ঠান্ডার জায়গা হিমাচলের একটা চার্চে গিয়ে থাকতে শুরু করেন | হিমাচল প্রদেশের কোটগড়ে ১৮৪৩ এ ইংরেজদের দ্বারা বানানো একটা চার্চ ছিল | সেই চার্চে এসে স্যামুয়েল থাকতে শুরু করেন আর হিমাচলের সিধেসাধা মানুষকে মিশনারী বুজরুকি দিয়ে ধর্মান্তকরণের কাজও শুরু করে দেন | এভাবেই চলতে থাকে সময় | ১৯১২ সালে, স্যামুয়েলের বয়স যখন ৩০, তখন তাঁর হাতেই খ্রিস্টান ধর্ম নেওয়া এক ভারতীয় মহিলা অ্যাগনেস কে খ্রিস্টান রীতিরেওয়াজে বিয়ে করে নেন স্যামুয়েল এবং হিমাচলেই থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন | প্রথমে এই বিয়ে তাঁর পরিবার মেনে নেয় নি | কারণ যতই হোক সেই মহিলা তো আর সত্যিকারের খ্রিস্টান নয়, তাছাড়া আমেরিকায় পারিবারিক ব্যবসার একমাত্র উত্তরাধিকারীও তো স্যামুয়েলই ছিলেন | কিন্তু স্যামুয়েলের জেদের সামনে তাঁর পরিবার নতি স্বীকার করে | ১৯১২ সালে সিমলার বারোবাগে ৩০০০০ টাকা দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি থেকে ২০০ একরের একটা চা বাগান কিনে সেই জমি স্যামুয়েলকে বিয়ের উপহার হিসাবে দেন তাঁর মা | স্যামুয়েল সেই চা বাগানকে আপেলের ক্ষেত বানিয়ে ফেলেন | ১৯১৬ সালে তিনি আমেরিকার লুইসিয়ানা যান | সেখান থেকে উত্কৃস্ট প্রকৃতির আপেল এর চারা নিয়ে এসে তাঁর ক্ষেতে চাষ করা শুরু করেন | সেই থেকেই হিমাচলে আপেলের চাষ হচ্ছে | মানে আজ যে হিমাচল Apple Bowl এর খেতাব পেয়েছে তার সম্পূর্ণ কৃতিত্বই স্যাম্য়েল ইভান স্টোক্স এর |
কিন্তু কাহিনী এখানে শেষ নয় | এখান থেকে শুরু | সেই সময় দেশে প্লেগের মহামারী চলছিল | প্লেগ মহামারী এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে এই রোগে আক্রান্ত হলে নিজের পরিবারও ছেড়ে চলে যেত | কিছু কিছু গ্রামে তো অবস্থা এমন শোচনীয় ছিল যে সেই গ্রামে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে সুস্থ গ্রামবাসীরা রোগী সমেত গোটা গ্রামে আগুন লাগিয়ে অন্যত্র চলে যেত | সেই সময় এই প্লেগ রোগীদের সেবা শুশ্রুসার কাজে সর্বতোভাবে লিপ্ত ছিল আর্য সমাজ | আর্য সমাজের একজন সন্যাসী পন্ডিত রুলিয়া রাম প্লেগ রোগীর সেবা করতেন | সারিয়ে তুলতেন | আর্য সমাজ ও পন্ডিত রুলিয়া রামের এই সেবাকর্ম মিশনারীদের ভীত নড়িয়ে দিয়েছিল | আপেল চাষী পাদ্রী স্যামুয়েল ইভান স্টোক্স এই পন্ডিত রুলিয়া রামের সংস্পর্শে আসেন সেই সময় | পন্ডিত রুলিয়া রামের সেবা নিষ্ঠা দেখে তাঁর সত্যের উপলব্ধি হয় | তিনি সেবার আসল রূপ দেখেন আর আসল মানব কল্যানের স্বরূপ আর ধর্ম কি হয় তা বুঝতে পারেন | সেবা মানে যে কুসংস্কার আর স্বার্থের কারণে সিধেসাধা মানুষের ধর্ম পরিবর্তন করা কখনই নয় সেটা তিনি বুঝতে পারেন | তিনি পন্ডিত রুলিয়া রামের কাছে যাতায়াত শুরু করেন | তাঁর সাথে সেবার কাজ করা শুরু করেন | পন্ডিত রুলিয়া রামের থেকে তিনি সত্য সনাতন বৈদিক ধর্মের বিষয়ে জানেন, ত্যাগ আর সেবার মর্ম বোঝেন, সনাতন ধর্মের বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন | আর্য সমাজের মন্দিরে নিয়মিত যাতায়াত করতে করতে কখন যে তিনি তত্কালীন ভারতের বিপ্লবীদের সাথে নিজেকে এক করে ফেলেন তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন নি | আর সমাজের বাকি বিপ্লবীদের সাথে স্যামুয়েল ইভান স্টোক্স, একজন আমেরিকান পাদ্রী, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হন | একমাত্র আমেরিকান যিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন | তাঁর এই পরিচয় ব্রিটিশদেরও খুব বিচলিত করে | ব্রিটিশ সরকার রাজ বিদ্রোহ আর সশস্ত্র আন্দোলনে সামিল হওয়ার কারণে স্যামুয়েলকে গ্রেফতার করে আর তাঁকে জেলে বন্দী করে |
কিন্তু বিধির বিধান ব্যর্থ হয় না | জেলে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় সেই সময়ে ওই জেলেরই আর এক বন্দীর সাথে | লালা লাজপত রায় | লালা লাজপত রায় তাঁকে “সত্যার্থ প্রকাশ” পড়তে দেন | “সত্যার্থ প্রকাশ” পড়তে পড়তে আর লালা লাজপত রায়ের মধ্যে দেশকে স্বাধীন করার অদম্য ইচ্ছা দেখতে দেখতে তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে | জেল থেকে বেরিয়ে তিনি পুরোপুরিভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে লেগে পড়েন | বেদ, উপনিষদ আর মনুস্মৃতির অধ্যয়ন করেন | শ্রীমদ্ভগবত গীতার ইংরাজি অনুবাদ পড়ে তার সঠিক মর্ম না বুঝতে পেরে সংস্কৃত শেখেন | তারপর সংস্কৃত শ্রীমদ্ভগবত গীতার অধ্যয়ন করেন | ১৯৩২ সালে স্যামুয়েল ইভান স্টোক্স, চার্চ, খ্রিস্টধর্ম, মিশনারী থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিজের নাম রাখেন সত্যানন্দ স্টোক্স | তাঁর স্ত্রী অ্যাগনেসের নাম হয় প্রিয়া দেবী | তাঁদের ছয় সন্তানের নাম হয় প্রীতম স্টোক্স, লালচন্দ স্টোক্স, প্রেম স্টোক্স, সত্যবতী স্টোক্স, তারা স্টোক্স আর সাবিত্রী স্টোক্স | সনাতন ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তিনি স্বামী সত্যানন্দ নামে পরিচিত হন | নিজের বাড়িতেই আর্য সমাজের মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন | সেই মন্দিরের কাঠের স্তম্ভের ওপর বেদ, উপনিষদ আর শ্রীমদ্ভগবত গীতার বহু শ্লোক খোদাই করেন | আজও সেই খোদাই করা শ্লোক দেখতে পাওয়া যাবে হিমাচলের ওই মন্দিরে | সেই সময়ে ওই মন্দির নির্মান আর তাঁর কাজের সুবিধার্থে তত্কালীন ভারতের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী যুগলপ্রকাশ বিড়লা ২৫০০০ টাকা দান করেন | আজ সেই মন্দির পরমজ্যোতি মন্দির বা অনন্তপ্রকাশ মন্দির নামে পরিচিত | স্বামী সত্যানন্দ স্বাধীনতার সূর্য দেখে যেতে পারেন নি | ১৪ই মে ১৯৪৬ এ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন | আজও তাঁর ওই মন্দির আর মন্দিরের স্তম্ভ আর দেওয়ালে খোদাই করা শ্লোক আর্য সমাজের ধর্মরক্ষার গুনগান করছে |
আমাদের আর আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য, এখানে ইসলামিক দস্যুদের নামের রাস্তা, স্টেডিয়াম, গ্রাম, শহর, স্টেশনের নাম আছে | হিন্দুহত্যা আর ধর্মান্তকরণ করে গাজী, কাজী, পীরদের মাজার আছে | একতা কাপুর আর তৈমুরের আব্বাকে আমরা পদ্মশ্রী দিয়েছি | কিন্তু স্বামী সত্যানন্দ স্টোক্সের নামে কোনো স্মৃতিসৌধ তো দূর, তাঁর অবদানকে ন্যুনতম স্বীকৃতি টুকুও দিই নি | কঙ্গনা রানাওত স্বামী সত্যানন্দ স্টোক্সের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটা চাপা পড়ে যাওয়া ইতিহাসকে সর্বসমক্ষে এনে সত্যিই আমাদের বড় উপকার করেছেন |